মোঃ সোহাগ বিশেষ প্রতিনিধি,
চাঁদার দাবিতে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স সাত ঘণ্টা আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরা স্বজনরা। মঙ্গলবার (০৬ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে লাশ নিয়ে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সচালকদের কাছে চাঁদা দাবি করেন মেডিক্যাল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি অনুপম সাহার অনুসারীরা। চাঁদা না পেয়ে সকালে হাসপাতালের সামনের সব অ্যাম্বুলেন্সের চাবি নিয়ে যান তারা। এতে দুর্ভোগে পড়েন রোগী ও লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরা স্বজনরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে স্বামীর লাশ নিয়ে বাড়ি যেতে না পেরে হাসপাতালের সামনে বসে কাঁদছেন নাহিদা ইয়াসমিন। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার গাজিরভিটা গ্রামের মোফাজ্জল হোসেনের স্ত্রী তিনি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোফাজ্জল হোসেন (৬০) হাসপাতালের ৪০৬ নম্বর ওয়ার্ডে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মারা যান। হাসপাতালের সব প্রক্রিয়া শেষে লাশ নিয়ে বের হয়ে বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করেছেন তিনি।
নাহিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘লাশ নিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সচালক রাসেলকে পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া করি। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা এসে চালকের সঙ্গে রাগারাগি করে গাড়ির চাবি নিয়ে যায়। এরপর থেকে লাশ নিয়ে বসে আছি। বাড়িতে নিয়ে বিকালে লাশ দাফনের কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে গেলো, এখন পর্যন্ত বাড়ি যেতে পারলাম না।’
শুধু মোফাজ্জল হোসেনের লাশ নয়, বেলা ১১টার পর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ছয়-সাত জনের লাশ নিয়ে হাসপাতালের সামনে বসে থাকতে দেখা গেছে স্বজনদের।
পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কোনও সুরাহা না হওয়ায় করোনা ওয়ার্ডে মারা যাওয়া নেত্রকোনার আব্দুস সাত্তারের লাশ সিএনজিতে করে বিকাল ৪টার দিকে বাড়ি নিয়ে গেছেন স্বজনরা।
আব্দুস সাত্তারের স্বজন সবুজ মিয়া বলেন, ‘ছাত্রলীগ নেতারা অ্যাম্বুলেন্সের চাবি নিয়ে যাওয়ার পর থেকে পাঁচ ঘণ্টা বসে ছিলাম। কিন্তু চাবি না দেওয়ায় অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ নামিয়ে সিএনজি ভাড়া করে নেত্রকোনায় রওনা হয়েছি। লাশ নিয়ে অনেক ভোগান্তিতে পড়েছি আমরা।’
অ্যাম্বুলেন্স চালক জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় মেডিক্যাল কলেজ শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি অনপুম সাহার ৫-৬ জন অনুসারী অ্যাম্বুলেন্সচালকদের বলে গেছেন, ছাত্রলীগ নেতাদের অনুমতি ছাড়া কোনও অ্যাম্বুলেন্স লাশ কিংবা রোগী নিয়ে যাবে না। অনুপমের সঙ্গে দেখা করে অ্যাম্বুলেন্স প্রতি টোকেন মানি দিতে রাজি হলে রোগী ও লাশ নেওয়া যাবে। এর বাইরে নয়।’
অ্যাম্বুলেন্সচালকরা জানিয়েছেন, এমন ঘোষণার পর জরুরি বিভাগের সামনে থেকে সব অ্যাম্বুলেন্স বের করে দেয় অনপুমের অনুসারীরা। বিষয়টি সমাধানে রাতেই ছাত্রলীগ সভাপতি অনুপমের সঙ্গে দেখা করেন অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি সেলিম মিয়া। আগামী শুক্রবার এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে চালকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে সব অ্যাম্বুলেন্সের চাবি নিয়ে যান অনুপমের অনুসারীরা। এতে হাসপাতাল থেকে বের হওয়া সব লাশ আটকেপড়ে। অ্যাম্বুলেন্সের চাবি নিয়ে যাওয়ায় চালক ও সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
ময়মনসিংহ অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি সেলিম মিয়া বলেন, ‘আমরা কাউকে চাঁদা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা করি না। ছাত্রলীগ নেতারা যে ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, এটি অত্যন্ত অমানবিক। এ ব্যাপারে মেডিক্যাল কলেজ অধ্যক্ষের কাছে বিচার চেয়ে আবেদন করবো।’
লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স আটকে ছাত্রলীগ নেতাদের চাঁদা দাবির বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছেন ময়মনসিংহ জেলার সাবেক ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদ জাহান শাহীন।
তিনি বলেন, ‘এটি অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। ছাত্রলীগকে চাঁদাবাজি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় জড়িত সবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ নামিয়ে সিএনজি ভাড়া করে নেত্রকোনায় রওনা হয়েছেন স্বজনরা
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. ওয়ায়েজ উদ্দীন ফরাজী বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সচালকদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাদের একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সুরাহা করে দেবে।’
জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. এনামুল হক বলেন, লাশ আটকে রাখার মতো বিষয়টি আমার জানা নাই। এ বিষয়ে খোঁজখবর নেবো।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে জেলায় সমালোচনা শুরু হলে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ছাত্রলীগ নেতারা হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের মাধ্যমে অ্যাম্বুলেন্সের চাবি ফিরিয়ে দিয়েছেন।
হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) শফিকুল ইসলাম বলেন, ছাত্রলীগ নেতাদের বলার পর অ্যাম্বুলেন্সের চাবি দিয়ে গেছেন। পরে চালকদের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যার পর লাশ নিয়ে গন্তব্যে গেছেন অ্যাম্বুলেন্সচালকরা।
এ ব্যাপারে জানার জন্য ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. চিত্ত রঞ্জন দেবনাথকে একাধিকবার কল দিলেও ধরেননি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি অনপুম সাহার মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও ফোন ধরেননি। এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়ে এসএমএস করলে ফোন বন্ধ করে দেন তিনি।